বিএনপি চিনতে একটি ঘটনাই যথেষ্ট
গাজী মনসুর
২৮ অক্টোবর বিএনপি অফিসে মিয়ান আরেফির উপস্থিতি, মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপিদেষ্টা হিসাবে পরিচয় দেয়া এবং সাংবাদিকদের সামনে মিথ্যা বলা দেখে অনেকেই খুব অবাক হচ্ছেন। গত কদিন ধরে এটাই আলোচনা হচ্ছে। আর আমি অবাক হয়েছি তাদের অবাক হওয়া দেখে। কারণ এটাইতো আসল বিএনপি। আজ যারা অবাক হচ্ছেন, তাদের বিষয়টা বোঝার কথা ছিল। কারণ বিএনপির এমন মিথ্যাচারের উদাহরণতো ভুরিভুরি। তাই পাঠক আগেই বলে দেই বিএনপির মিথ্যাচারে অবাক হবেন না।
মিয়ান আরেফি এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন, তিনি কীভাবে এখানে এলেন। কে তাকে এখানে এনেছে। এরই মধ্যে সেই মহান কৃতি গুজব কুমার হাসান সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এখন আলোচনা হওয়া দরকার তাকে নিয়ে। বিএনপি কিন্তু এই লোককে ঠিকই খুঁজে বের করেছে। বলেতেই হবে, রতনে রতন চেনে। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই বিএনপি জানে, কাকে দিয়ে কোন কাজটি হবে। তারা আরও জানে বিরোধীদের ঘায়েল করার জন্যে গুজবের চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই।
এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি বলেছেন, মিয়ান আরেফি যা যা বলেছে তা পুরোপুরি অসত্য এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোন বেসরকারি মানুষকে দিয়ে এমন কথা বলায় না। আসলে এই ঘটনার মধ্যদিয়ে বিএনপির নোংরা চক্রান্ত এবং জনসাধারণের সাথে করা দিনের পর দিনের ঘৃণ্য প্রতারণা ফাঁস হয়ে গেছে। কারণ বিএনপির এমন প্রতরণা প্রথম না। পাঠক চলুন আলোচনার সুবিধার জন্যে, আমরা বিএনপির কিছু আলোচিত মিথ্যাচার সম্পার্কে জেনে নেই।
খালেদা বনাম অমিত শাহর ফোনালাপ
২০১৫ সালের ৯ই জানুয়ারি। দেশের সব সংবাদপত্রে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান অফিস থেকে জানানো হয়, ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ খালেদা জিয়াকে আগের রাতে ফোন করে তাকে ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তার স্বাস্থ্য নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই এই বক্তব্যের গোমর ফাঁস হয়। বিজেপি সভাপতির একান্ত সচিব এস রানা দিল্লিতে সাংবাদিকদের জানান– ‘বাংলাদেশের কাউকে অমিত শাহ্ ফোন করেননি’। বাংলাদেশ থেকে কোন ফোনও আসেনি।
যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ছয় সদস্যের বিবৃতি
২০১৫ সালের ৭ই জানুয়ারি প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, ইউএনবিসহ বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দুটি অনলাইন সংবাদ পোর্টালে নিউজ আসে যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা এবং তার ছেলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যান। সেই নিউজে রয়েস ও অ্যাঙ্গেল ছাড়াও রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য স্টিভ শ্যাবট, জর্জ হোল্ডিং ও ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য জোসেফ ক্রাউলি ও গ্রেস মেং ওই বিবৃতিতে সই করেছেন বলে দাবি করা হয়। যেখানে কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষর পর্যন্ত জালিয়াতি করে, ওই বিবৃতিটি, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, এক সহকারী সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন।
পরে রয়েস ও অ্যাঙ্গেলের পক্ষ থেকে পাঠানো আরেক বিবৃতিতে বলা হয়, ছয় কংগ্রেস সদস্যের নামে ৭ জানুয়ারির যে বিবৃতির বরাত দিয়ে, বাংলাদেশের কিছু সংবাদ মাধ্যমে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা ‘বানোয়াট’। পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি ও কংগ্রেস সদস্যদের অনেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এলেও কমিটি বা কোনো সদস্য এ ধরনের কোনো বিবৃতি দেননি।
জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার বৈঠক নিয়ে মিথ্যাচার
২০২২ সালের ১৭ই মার্চ গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত কী বলেছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সম্বন্ধে বিশ্বব্যাপী সবাই অবগত আছে। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এসব ব্যাপারে তাঁরা উদ্বিগ্ন।
২০২২ সালের ২০শে এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিকাব) এর আলোচনা সভায় আখিম ট্র্যোস্টার আমীর খসরুর এই কথার প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে আমাকে উদ্ধৃতি করে বক্তব্য দিয়েছেন তা ঠিক নয়। তিনি এরকম কোন কথাই বলেননি। এঘটনায় তিনি প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেন।
এতো মাত্র কয়েকটি উদাহরণ। আজ বলে নয়। জন্মের পর থেকেই তাদের এই গুজব নির্ভর অবস্থান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন তাদের এই মিথ্যের বেসাতি? সেই প্রশ্নের জবাব রয়েছে আজকের মিয়ান আরেফি ও সোহরাওয়ার্দীর অনুকাব্যে। পাঠক দেখুন কার ওপর বিশ্বাস আনলো বিএনপির লন্ডনি কেন্দ্র? যে কিনা দীর্ঘদিন অনলাইনে ঘৃণা ছড়িয়ে দীর্ঘদিন গলা পাকিয়েছে। যে বিদেশে বসে গুজবি নেট্ওয়ার্ক গড়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একের পর এক মিথ্যাচার করেছে। এমন যোগ্য লোককে কীভাবে হাতছাড়া করবে বিএনপি?
বছরের পর বছর প্রতারণা পরও বিএনপির এই প্রতারণা মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। একটি উচ্চ রাজনৈতিক সচেতন শ্রেণি বুঝেছে হয়তো। কিন্তু খুব রহস্যজনক কারণে এনিয়ে বেশি কথা হয়নি। এবারের মিথ্যাচারটি একাবারে প্রকাশ্য। তবুও কিন্তু যে রকমভাবে প্রচার হওয়ার কথা ছিল, সেই রকমভাবে হচ্ছে না। কোথায় যেন, একটা ঢাকঢাক ব্যাপার আছে। কারণ এরইমধ্যে প্রকাশ্যে আসা উচিত ছিল মিয়ান আরেফির সঙ্গে এই মিথ্যাচার করার বিনিময় কি ছিল? তাদের নেট্ওয়ার্কের অন্যান্য গুজববাজ কারা? তিনি কীভাবে তাদের টাকা দেন? কাকে কত দেন? সেই অর্থের উৎস কোথায়? অথচ আজকের দিনে এসব তথ্য পাওয়া খুবই সহজ।
বাংলাদেশের সব মানুষের সামনে বিষয়গুলো প্রকাশ্য হওয়া দরকার। কারণ পুরো দেশেটাই আজ গুজবভরা ইমেজে ঠাসা। অনেকেই জানে না, বিএনপির মূলভিত্তি গুজব, তাদের মানুষের ভোটের ওপর কোন আস্থা নেই। তারা সব সময় চেষ্টায় থাকে কিভাবে বিদেশি লবিস্ট, অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা যায়। তারা বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে নানা গুজব রটিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
তারা জানে না যে, বর্তমান সময়েও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি.হাস নগ্নভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।